আজ পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী


জসীমউদ্দীন একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি। তিনি বাংলাদেশে পল্লী কবি হিসেবে পরিচিত। তার পুরো নাম জসীমউদ্দীন মোল্লা।তার লেখা কবর কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য অবদান।তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যে এক নতুন আবহ সৃষ্টি করেন। তাঁর কাব্যের ভাব, বিষয়, শব্দ, চরিত্র, প্রকরণ, ছন্দ, অলংকার, গঠন-কৌশল, আবেদন ইত্যাদি সবই ভিন্ন স্বাদ ও মেজাজের। সমকালীন কবিরা যখন সকলেই আধুনিক নগর-চেতনায় উদ্বুদ্ধ, যান্ত্রিক সভ্যতার জটিলতায় যন্ত্রণাবিদ্ধ, জসীমউদ্দীন তখন চিরায়ত গ্রামীণ জনপদ, আবহমান লোকজ ঐতিহ্যের সুস্মিত ধারায় পরিস্নাত এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কবি হিসেবে ভিন্ন মাত্রিক সৃজনশীলতায় বাংলা সাহিত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে ব্যাপৃত হন।
গ্রামীণ জনপদের সহজ, সরল, সাধারণ মানুষ, তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাত্রা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-কোলাহল, ছায়া-ঢাকা সবুজ অরণ্য, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, শস্য ভরা ক্ষেত, নদী-নালা, ফুল-পাখি ইত্যাদি জসীম উদ্দীনের কাব্যে অসাধারণ বর্ণ-সুষমায় মনোমুগ্ধকররূপে রূপায়িত হয়েছে। লোকজ শব্দের স্বচ্ছন্দ ব্যবহার ও লোকজ জীবন-স্বভাবের অন্তরঙ্গ বর্ণনায় তিনি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। ফলে বাংলা কাব্যে তিনি নতুন ধারার প্রবর্তক ও স্বতন্ত্র মৌলিক প্রতিভার অধিকারী কবি হিসাবে পরিচিহ্নিত ও স্বীকৃত। জসীমউদ্দীন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেনঃ ‘‘জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নূতন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে।’’

জীবন বৃত্তান্ত

তিনি ১৯০৩ সনের পহেলা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার বাড়ি ছিলো একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। জসীমউদ্দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল, ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সনে উত্তীর্ন হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১ সনে। ১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগদেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৩ মার্চ ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে তার নিজ গ্রাম বিমলগুহে সমাধিস্থ করা হয়।

রচনাবলী

কাব্যগ্রন্থ
·         রাখালী (১৯২৭)
·         নকশী কাথার মাঠ (১৯২৯)
·         বালু চর (১৯৩০)
·         ধানখেত (১৯৩৩)
·         সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪)
·         হাসু (১৯৩৮)
·         রঙিলা নায়ের মাঝি(১৯৩৫)
·         রুপবতি (১৯৪৬)
·         মাটির কান্না (১৯৫১)
·         সকিনা (১৯৫৯)
·         সুচয়নী (১৯৬১)
·         ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২)
·         মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩)
·         হলুদ বরণী (১৯৬৬)
·         জলে লেখন (১৯৬৯)
·         কাফনের মিছিল ((১৯৮৮)
নাটক
·         পদ্মাপার (১৯৫০)
·         বেদের মেয়ে (১৯৫১)
·         মধুমালা (১৯৫১)
·         পল্লীবধূ (১৯৫৬)
·         গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯)
·         ওগো পুস্পধনু (১৯৬৮)
·         আসমান সিংহ (১৯৮৬)
আত্মকথা
·         যাদের দেখেছি ((১৯৫১)
·         ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় (১৯৬১)
·         জীবন কথা ( ১৯৬৪)
·         স্মৃতিপট (১৯৬৪)
উপন্যাস
·         বোবা কাহিনী (১৯৬৪)
ভ্রমণ কাহিনী
·         চলে মুসাফির (১৯৫২)
·         হলদে পরির দেশে ( ১৯৬৭)
·         যে দেশে মানুশ বড় (১৯৬৮)
·         জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫)
সঙ্গীত
·         জারি গান (১৯৬৮)
·         মুর্শিদী গান (১৯৭৭)
অন্যান্য
·         বাঙালির হাসির গল্প
·         ডালিমকুমার (১৯৮৬)

পুরস্কার

·         প্রেসিডেন্টস এওয়ার্ড ফর প্রাইড অফ পারফরমেন্স ১৯৫৮
·         একুশে পদক ১৯৭৬
·         স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৭৮ (মরণোত্তর)
·         ১৯৭৪ সনে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
·         রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট ডিগ্রি (১৯৬৯)

তথ্যসূত্র

http://bn.wikipedia.org 


কবি জসীমউদদীনকে নিয়ে লেখা জীবন ছন্দের সুরেলা বাঁশি নামক একটি প্রবন্ধে ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ বলেনঃ কবি জসীমউদদীন জীবনকে উপলদ্ধি করেছেন জীবনের অস্থিমজ্জায় অনুসন্ধানী ডুবুরীর বেশে। হৃদয়কে আত্মস্থ করেছেন হৃদয় জমিনে আদর্শ চাষীর মতো চাষবাস করে। সমাজের অবহেলিত মানুষকে বিশ্লেষণ করেছেন নিজের জীবনের গাণিতিক ছন্দে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলা ভাষাভাষী গ্রামীণ মানুষকে হৃদয়ের আয়নায় চিত্রিত করে আপনার সাথে একাকার করেছেন। তাদের হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, সুখ-সাচ্ছন্দ, আনন্দ-বিনোদন সব কিছুর ব্যারোমিটারে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন তিনি। তাইতো তাঁর কাব্যভাষা, উপমা এমনকি কাহিনীর পাত্র-পাত্রীকে পর্যন্ত খুঁজে নিয়েছেন গ্রাম-গঞ্জ, মাঠ- ঘাট এবং সবুজের সমারোহ থেকে।
কবি জসীমউদদীন ছিলেন ভীষণ রকম আবেগ প্রবণ শিশু মনের সরল মানুষ। লোক সাহিত্যের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল অসাধারণ। প্রবাদ প্রবচন, লোককথা, যাত্রাগান, গাঁথার প্যাচালি, কবিয়ালের আসর প্রভৃতির প্রতি তিনি নিজেকে বিলীন করে দিতে চাইতেন। যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই গ্রামীণ সংস্কৃতির সম্মানে তিনি এভাবেই খুঁজে বেড়িয়েছেন মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ আবহ। এমন আগ্রহের কারণেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই ড· দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতুনলাহিড়ী সহকারী গবেষক রূপে লোকসাহিত্য সংগ্রহায়ক নিযুক্ত করেছিলেন। ফরিদপুর জেলার গোবিন্দপুর গ্রামের জন্ম নিয়ে কলকাতা পর্যন্ত গোটা বাংলার পল্লী কুঠিরকে চষে বেড়িয়েছেন শেকড়ের সন্ধানে। তাঁর জীবন আচরণও পল্লীর সাথে সাদৃশ্য করে ফেলেছিলেন। রাজধানীর পুরাণ ঢাকায় বসবাস করেও তিনি পল্লী প্রকৃতিকে ভুলে যাননি মুহুর্তের জন্য। বেশভূষা, চলাচল এমনকি নিজ বাড়িটাও গরু ছাগল ও গাছ গাছালিতে গ্রামীণ ঢঙ্গে সাজিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সত্যিকার অর্থে জসীম উদ্দীন শুধু কলমের ডগায় নয়, গ্রাম বাংলার ভালবাসাকে সাজিয়ে নিয়েছিলেন গোটা অঙ্গে-ভিতরে বাইরে। তাইতো তিনি পল্লী বাংলার অমর কবি, জীবন ছন্দের সুরেলা বাঁশি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হাস্য-কৌতুকের আসর

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও নারীর অধিকার 

স্বাধীনতার মাসঃআমাদের অঙ্গীকার